সাদেকুর রহমান বাঁধন:
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আর ঈদের এই আনন্দের মাঝে বাড়তি আর্কষণ পরিবার ও প্রিয়জনের সঙ্গে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা। এবারের ঈদে চাইলে ঘুরে যেতে পারেন উত্তর সীমান্তবর্তী ও ইতিহাস বিজড়িত জেলা নওগাঁয়। এ জেলায় রয়েছে আর্কষণীয় নানা স্থান ও স্থাপনা।
১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ১১টি উপজেলা নিয়ে নওগাঁ জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। ৩ হাজার ৪৩৫ বর্গ কিলোমিটারের সীমান্তবর্তী এ জেলা বৈচিত্র্যে ভরপুর। ছোট ছোট নদী বহুল এ জেলা প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি কাজের জন্য প্রসদ্ধি। অসংখ্য পুরাতন মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও জমিদার বাড়ি, প্রাচীন স্থাপনা প্রমাণ করে নওগাঁ জেলা সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরাতন।
জেলা বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ইতিহাস বিজড়িত নানা স্থান ও স্থাপনা। যেখানে গেলে আপনার মনকে নাড়া দেবে গভীরভাবে। এবারের ঈদে ঘুরতে যেতে পারেন এ জেলার যেসব ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনায় জেনে নেওয়া যাক উল্লেখযোগ্য সব দর্শনীয় স্থানের কথা।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর মহাবিহার
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ২৭কিলোমিটার দূরে বদলগাছী উপজেলার পাহারপুর ইউনিয়ের অবস্থিত ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর মহাবিহার। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।
পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা হয়। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা হয়। মোট ৭০.৩১ একর জমির উপর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটি অবস্থিত। বিহারটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। আকর্ষনীয় স্থাপত্য বিশাল আয়তন ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার আজ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত। প্রতিদিন এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও সাধারণ মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক এই মহাবিহারটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ বিহার বলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। যা আপনাকে নজর কাড়াবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর কাছারিবাড়ি
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ বিশ্বকবির এ বিখ্যাত কবিতাটি তিনি লিখেন নওগাঁ আত্রাইয়ের পতিসরের কাছারিবাড়িতে বসে।
পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদীকে কেন্দ্র করেই এটি লেখেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৯১ সালের পর কবি বহুবার এসেছেন পতিসর কুঠিবাড়িতে নাগর নদী পথে বজরায় চড়ে। ১৮৯১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এ পতিসরে বসে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিঠিপত্র, কাব্য নাটিকা লেখেন।
১৯৩৭ সালে ২৬ জুলাই কবি শেষবারের মতো এসেছিলেন তার পতিসরের কাছারিবাড়িতে। কবির ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ সালে এ এলাকার প্রজাদের জন্য সর্বপ্রথম কলের লাঙ্গল এনেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার ১৯৫২ সালে এক অর্ডিন্যান্স বলে কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি কেড়ে নিলে ঠাকুর পরিবারের এ জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সস্ত্রীক পতিসর যাতায়াত বন্ধ করে দেন। কবির কাছারিবাড়ির এখন মিউজিয়াম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ১৫ টাকার টিকিট নিয়ে এ মিউজিয়ামে ঢুকতে পারবেন। জেলা শহর ৪০ কিলোমিটার দূরে পতিসর কাছারিবাড়ি অবস্থিত।
দিবরদিঘী
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা থেকে ১৬ কিমি. পশ্চিমে সাপাহার-নওগাঁ সড়কের পাশেই ঐতিহাসিক দিবর দীঘি অবস্থিত। দিবর দীঘির ঐতিহাসিক পটভূমি ছাড়াও রয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দীঘির মূল ঘাটে প্রবেশ করার সময় দু’পাশে উইপিং দেবদারু গাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা আপনাকে স্বাগত জানাবে।
দীঘির পাড়ে কয়েকশ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছের সমন্বয়ে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প এবং দীঘির পশ্চিম পাড়ে বিশাল আম-কাঁঠালের বাগান। দীঘিটিকে ঘিরে লোকমুখে অনেক গল্প কাহিনী, কাল্পনিক গল্প-কথা প্রচলিত। এই দিঘীর মাঝখানে রয়েছে আশ্চর্যজনকভাবে স্থাপিত অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ। সুদূর অতীতের বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্যের সাক্ষ্য বহন করছে আজও। অর্ধ বর্গ বিঘা দীঘির মধ্যখানে অবস্থিত আট কোণাবিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এতবড় স্তম্ভ বাংলাদেশে বিরল। এটিকে জয়স্তম্ভ নামে ডাকা হয়। সবার কাছেই ওই দীঘিটি কর্মকারের জলাশয় নামে পরিচিত। স্তম্ভটির সর্বমোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নিচের অংশ ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং পানির উপরের অংশ ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। স্তম্ভটির ব্যাস ১০ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রতিটি কোণের পরিধি ১ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। স্তম্ভের উপরিভাগ খাঁজকাটা অলঙ্করণ দ্বারা সুশোভিত।
আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৬১ কিমি. উত্তর ভারতীয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান। প্রায় ২০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে আলতাদীঘি শালবন, যা আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত। এর মাঝখানেই ৪৩ একরের আয়তনের বিশাল আলতাদীঘি। এছাড়া শালবনের আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। দিঘির স্বচ্ছ পানিতে ফুটে থাকা হাজারো পদ্মফুল যেকোন ভ্রমণপিপাসু মানুষকে বিমোহিত করবে। প্রতি বছর শীত যখন জেঁকে বসে, তখন ভারত সীমান্ত ঘেষা এই দীঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির নাম না জানা অতিথি পাখি এসে দিঘীর নির্মল পানিতে দাপিয়ে বেড়ায়, ডাহুক, পানকৌড়ির কলকাকলি আর তাদের চঞ্চল উড়াউড়িতে প্রাণ প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয় যেকোনো বয়সের মানুষের হৃদয়। এছাড়া শালবনে রয়েছে ঔষধিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এক দিকে পর্যটক ও দর্শকদের আনন্দ ও বিনোদন যেমন বেড়েছে তেমনি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজার রাখার জন্য এ বনাঞ্চল যথেষ্ট অবদান রাখছে।
জগদ্দল বিহার
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে ধামইরহাট উপজেলার জগদ্দল গ্রামে অবস্থিত জগদ্দল বিহার । একাদশ শতকে বিদ্রোহী বঙ্গাল সৈন্য কর্তৃক পাহাড়পুর (সোমপুর) বিহার আক্রান্ত ও অগ্নিদগ্ধ হয়। এই বিশৃঙ্খলা এবং বাইরের আক্রমণের ফলে পাল সাম্রাজের সার্বভৌমত্ব লুণ্ঠন হয়ে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চল কিছু কালের জন্য স্থানীয় কৈবত নায়েব দিব্যোক এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র ভীমের শাসনাধীনে চলে যায়। একাদশ শতকের শেষার্ধে ভীমকে পরাজিত করে রামপাল প্রিয় পিতৃভূমি বরেন্দ্র উদ্ধার করেন। তিনি প্রজা সাধারণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জনের জন্য মালদহের সন্নিকটে রামাবতী নামক রাজধানী এবং এর নিকটবর্তী স্থানে জগদ্দল বিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। ইউনেস্কো ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্ভাব্য তালিকায় জগদ্দল বিহারের নাম রয়েছে।
হলুদ বিহার
হলুদ বিহার বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর স্বীকৃত একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান। নওগাঁ শহর থেকে ১৫কিলোমিটার দূরে বদলগাছীর বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে এর অবস্থান। বর্ষাকালে হলুদ বিহার ঢিবিটি দ্বীপের মতো দেখাতো। যার ফলশ্রুতিতে এটি দ্বীপগঞ্জ নামে পরিচিত। দ্বীপগঞ্জ গ্রামের হাটের পাশে স্তূপকৃত মাটির ঢিবি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ঢিবির পরিধি প্রায় ১০০ ফুট এবং সমতল ভূমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুসন্ধানে এটি একটি বৌদ্ধ বিহার বলে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু কিছু ঐতিহাসিকরা এটিকে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের সমসাময়িক বলেই মনে করেন। তবে এর নির্মাণে শুধু সিঁড়ির ইটের সঙ্গে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের পশ্চিম পাশের ইটের মিল পাওয়া যায়। হলুদ বিহারের একটি প্রাচীন পথ কোলা অতিক্রম করে পাহাড়পুর, আরেকটি পথ জগদল মহাবিহারের অগ্রসরমান। অবস্থাদৃষ্টে এ বিহার তিনটির মধ্যে গভীর যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হয়।
দুবলহাটি রাজবাড়ি
নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিনে দুবলহাটি ইউনিয়নে অবস্থিত দুবলহাটি রাজবাড়ি। জমিদার বাড়িটি প্রায় দুই’শ বছরের পুরোনো। বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় এটি বেশ বড়। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ এই অঞ্চলটিতে শাসনকার্য শুরু করেন। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪শ ৯৫ টাকায় জায়গাটি কিনেছিলেন। রাজা কৃষ্ণনাথের কোনো সন্তান বেঁচে না থাকায় তার নাতি রাজা হরনাথ রায় ১৮৫৩ সালে সেখানকার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। রাজা হরনাথের শাসনামলে দুবলহাটি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়। দুবলহাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তিনি বিভিন্ন নাট্যশালা এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন, প্রাসাদের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে সাধারন মানুষদের পানির চাহিদা পূরণ করতে পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে জমিদার পরিবারের উদ্দ্যোগে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টির নামকরণ রাজা হরনাথের নামে করা হয়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের পর রাজা হরনাথ ভারতে চলে যান। কিন্তু এক গৌরবান্বিত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে প্রাসাদটি।