অনলাইন ডেস্ক:
মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদালতের এই আদেশের ফলে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি থাকছে না চার সপ্তাহ। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল তা বহালই থাকলো।
এদিকে রাজপথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে আপিল বিভাগ আদেশে বলেছে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য এই আদালতে উপস্থাপন করতে পারবেন। আপিল বিভাগ মূল দরখাস্ত (হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল) নিষ্পত্তিকালে তাদের বক্তব্য যথাযথভাবে বিবেচনায় নেবে। এছাড়া সকল প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ তাদের ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ভূমিকা রাখবেন। এই তিন দফা নির্দেশনা দিয়ে বুধবার হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থার আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ।
শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোটার বিষয়টি হাইকোর্ট একভাবে নিষ্পত্তি করেছে। সেটা সঠিক না বেঠিক হয়েছে সেটা দেখার অধিকার একমাত্র আপিল বিভাগের। আপিল বিভাগ ছাড়া সেটা কোনোভাবেই পরিবর্তন বা সংশোধন সম্ভব নয়। এই বার্তাটা কেন রাজপথে থাকা শিক্ষার্থীদের বোঝানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় বড় জায়গায় রয়েছেন তারা কেন শিক্ষার্থীদের এটা বলেন না যে এটা আন্দোলনের বিষয় না। তোমরা কোর্টে যাও, নিজেদের বক্তব্য তুলে ধর, আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দিতে পারি সেই ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আমরা সরকারকে নির্দেশনা দিতে পারি এটা করেন। এটাও বলতে পারি রায়টি সঠিক বা বেঠিক হয়েছে। কোনটা বলব সেটা হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় আমাদের সামনে আসার পর। এজন্য বলছি রায়টি আমাদের সামনে আসুক, সেটা আসলে আমরা যথাযথভাবে তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেব।
আপিল বিভাগের এই আদেশের পর আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে পরিপত্র জারি করে সরকার। সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তার ভিত্তিতে কোটা পদ্ধতি বহাল করে নতুন করে কোন ধরনের পরিপত্র জারি করেনি সরকার। এ কারণে রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা দেওয়ায় কোট পদ্ধতি বাতিল সংক্রান্ত ২০১৮ সালে জারি করা সরকারের পরিপত্র বহালই থাকল। কারণ স্থিতাবস্থা হচ্ছে আদালতের এক ধরনের স্থগিতাদেশ। যে আদেশে রায়ের কার্যকারিতা থাকে না।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কোটার মামলায় কী সিদ্ধান্ত আসে সর্বোচ্চ আদালত থেকে সেজন্য শুনানি শুনতে উপস্থিত হয়েছিলেন ৪০০-৫০০ আইনজীবী। শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে বলেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকারের পরিপত্র এক রিট মামলার রায়ে বাতিল করেছে হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়টি এখনো পাইনি। রায় পেলে আপিল করব। সেই সময় পর্যন্ত রায় স্থগিতের আবেদন করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, সরকার কর্তৃক গঠিত সচিব কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। বর্তমানে কোটা পদ্ধতি নিয়ে চলা আন্দোলন নিরসনের জন্য রায় স্থগিত হওয়াটা দরকার।
রিটকারী মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারা কারো কাছে কোটা চাইনি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর পর্যন্ত এই কোটা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কোটা বাস্তবায়ন করে। তখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান না পেলে মেধাবীদের মধ্য থেকে কোটা পূরণ করা হয়। তিনি বলেন, কী কারণে হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছে পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে জানা যাবে। রায় স্থগিতের আবেদনের বিরোধিতা করছি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, চাকরিতে কোটা পদ্ধতি থাকবে কি থাকবে না সেটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এই নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর আদালত কতটুকু হস্তক্ষেপ করতে পারবে সেটা আপিল বিভাগও অবহিত। এই বিষয়ে আপিল বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত আসা দরকার।
প্রসঙ্গত কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলনের পর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ত্রয়োদশতম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়, ‘সরকার সব সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ সম(বিধি-১)এস-৮/৯৫(অংশ-২)-৫৬(৫০০) নং স্মারকে উল্লিখিত কোটা পদ্ধতি নিম্নরূপভাবে সংশোধন করিল: (ক) নবম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হইবে; এবং (খ) ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হইল।’ কোটা বাতিল করে জারি করা এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন ওহিদুল ইসলামসহ সাত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ওই রিটের রায়ে হাইকোর্ট সরকারি চাকরির ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ বিদ্যমান কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এই রায় স্থগিত চেয়ে পৃথক দুটি আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী। সূত্র: ইত্তেফাক