বিশেষ প্রতিনিধি:
এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৭ শতাংশ| তামাক ও তামাকাজাত দ্রব্যের ব্যবহার অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে করারোপের মাধ্যমে ক্রয়মূল্য ভোক্তার ক্রয় সক্ষমতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া জরুরি। কিন্তু একাধিক মূল্যস্তরভিত্তিক কাঠামোর মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। এই সুযোগে কোম্পানিগুলো সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব ফাকি দিয়ে ক্রমশই তাদের লাভের পাল্লা ভারি করছে।
বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের বিদ্যমান শেয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসাবে চিহ্নিত। একাধিক সরকারি কর্মকর্তা তামাক কোম্পানির নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে দায়িত্বরত থাকার কারণে কোম্পানিগুলো নানাবিধ অনৈতিক সুযোগ সুবিধা পায়। তামাক নিয়ন্ত্রণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয় এবং কোম্পানিতে সরকারের বিদ্যমানশেয়ার পরষ্পর বিপরীতমূখী। বিগত অর্থবছরগুলোতে কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপের ফলেই বাজেটে তামাকের উপর উল্লেখযোগ্য হারে কর বৃদ্ধি করা স্ম্ভব হয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশে বর্তমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল ও মূল্যস্তরভিত্তিক হওয়ায় কোনো এক স্তরের দাম বাড়লেও ব্যবহারকারীরা সহজেই নিম্নস্তরের সিগারেটে চলে যেতে পারে। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধূমপায়ীদের সিগারেট গ্রহণের হার আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সরকার নির্ধারিত ৪টি মূল্যস্তরের বিষয়টি অমান্য করে এর মাঝামাঝি মূল্যে ‘রয়েল (১২০ টাকা)’ ও ‘লাকি স্ট্রাইক (২০০ টাকা)’ নামক আরও দুটি ভিন্ন মূল্যস্তরের সিগারেট বাজারজাত করা শুরু করেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ। যা সম্পূর্ণভাবেই প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।
উল্লেখ্য, বিএসটিআই’র পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা, ২০২১-এর বিধি-৫-এর উপবিধি (৬) অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্যের মোড়কের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য মুদ্রিত থাকতে হবে এবং সেটিই হবে ভোক্তা মূল্য। সকল মোড়কজাত পণ্যের ক্ষেত্রে এই আইন ব্যবহৃত হলেও তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। মূলত কোম্পানিগুলো মূসক আইন ও বিধিতে প্রভাব খাটিয়ে এসআরওতে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘খুচরা মূল্য’ লিখিয়ে নিয়েছে। এছাড়া খুচরা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সুযোগ নিয়ে বিক্রেতারা প্যাকেট প্রতি অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছে। উপরন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সার প্রচলন না থাকার কারণে খুচরা সিগারেট শলাকা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের সুযোগ পায় বিক্রেতারা। ফলে সরকার প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা রাজস্ব হারায় [প্যাকেটে মুদ্রিত দামে সিগারেট বিক্রি নিশ্চিত করা জরুরি, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেয়ার বিজ নিউজ, ১৩ মার্চ ২০২৩]।
ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এর মধ্যকার সময়ে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট কর্তৃক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা দোকানে বিক্রিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের মূল্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, ক্রেতাদের কাছ থেকে স্থানভেদে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে ১০-৩৫ টাকা অধিক মূল্য আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত মূল্য হলো খুচরা বিক্রেতার ক্রয় মূল্য। অথচ, অন্যান্য সব ক্ষেত্রে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করেন এবং লাভসহ মোড়কে উল্লিখিত মূল্যে বিক্রয় করেন।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তামাকের উপর অতি-নির্ভরশীলতা তামাক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম প্রধান বাঁধা। এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যম হিসাবে তামাকের পরিবর্তে বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজে বের করা জরুরী। এছাড়া, তামাক কোম্পানির বিদ্যমান কর ফাঁকি রোধে তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার, কার্যকর তামাক করনীতি প্রণয়ন, সকল প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায় ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে খুচরা সিগারেট বিক্রয় নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি সকল তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন এবং করের আওতায় আনতে হবে।