আঁখি, বয়স ৩৫ বছর। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার ঘোষনগর এলাকার বেশিরভাগ মানুষের কাছে একনামে পরিচিত। বাবা আইজুল কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং মা বেবি বেগম একজন হোমমেকার। তিনি ২ বোন ও ১ ভাই এর মধ্যে সবার বড়। ৫ম শ্রেণী পাশ করার পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে আঁখির বিয়ে হয় একই গ্রামের খয়ের উদ্দীনের ছেলে হোসেনের সাথে। তাদের একমাত্র সন্তান আল হাদি(১৭) স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেনীতে লেখা-পড়া করছে।
দরিদ্রতা, ভয়-ভীতি, লোকলজ্জা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসহ সকল প্রতিক‚লতাকে জয় করে উদ্ভাসিত আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছেন হার না মানা আঁখি। দরিদ্রতা তার জীবনকে থামাতে পারেনি- ইচ্ছা থাকলে কোনো বাধাই জীবন চলার পথে দাঁড়াতে পারে না কাঁটা হয়ে এবং নিজেকে সমাজের একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়- আঁখি যেন তারই প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি সবসময় আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। আর তার সেই আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়ায় দরিদ্রতা। কারণ এই দরিদ্রতার কাছে হার মেনেই তা মা-বাবা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। তার মা-বাবা ভেবে ছিলেন বিয়ের পর তাদের বোঝা কিছুটা হাল্কা হবে এবং মেয়েও হয়তো কিছুটা ভালো থাকবে। কিন্তু বিয়ের পরও দরিদ্রতা তার পিছু ছাড়েনি। তিনি একাধিকবার ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছেন। তবে পারিবারিক অসহযোগিতা, লোকলজ্জা-মানুষ কি বলবে? আবার প্রতিবেশীরাও ব্যবসা শুরু করার আগেই সমালোচনা শুরু করে। তাই পরিবার ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তার পরিকল্পনা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আঁখির জীবন আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্যে পতিত হয়।
আঁখির জীবনে আশা-নিরাশার এই দোলাচল যখন চলছিলো এমনি একসময় ঘোষনগর এলাকায় গগনপুর আলট্রা পুওর গ্রাজুয়েশন কর্মসূচির শাখা অফিসের আওতায় ২০২২ কোহটের সদস্য নির্বাচনের জন্য পিআরএ পরিচালনা করা হয়। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আঁখি আলট্রা পুওর গ্রাজুয়েশন কর্মসূচির এন্টারপ্রাইজ: গবাদি প্রাণী পালন (বকনা বাছুর পালন) এর একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তিনি গ্রæপ-৩ এর সদস্য হওয়ায় তাকে ২৪৫০০/- টাকা সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা হয়, যে টাকা দিয়ে তিনি নিজে একটি বকনা বাছুর ক্রয় করেন। এবার শুরু হয় তার ঘুরে দাড়ানোর পালা। কারণ তাকে ঋণ প্রদানের পাশাপাশি প্রতি মাসে ২বার গ্রæপ ভিজিট ও হোম ভিজিটে ইস্যু ভিত্তিক সচেতনতামূলক সেশন পরিচালনা করার পাশাপাশি এবং সফলভাবে বকনা বাছুর পালনে তাকে কারীগরি সহায়তা প্রদান হয়।
আঁখি আলট্রা পুওর গ্রাজুয়েশন (ইউপিজি) কর্মসূচির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেই ২০২১ সালে ইউপিজি কর্মসূচির সকল কর্মীকে জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং ওরিয়েন্টেশনের আওতায় আনা হয়। ২১ জুলাই ২০২২ তারিখে গগনপুর অফিসে জেন্ডার ডায়ালগ ও জেন্ডার মার্কার ওরিয়েন্টেশন সম্পন্ন করা হয়। ইউপিজি কর্মসূচির মাসিক কর্মী সভায় জেন্ডার ইন্ডিকেটর ভিত্তিক আলোচনা সেশন পরচালনা করা হয়। এছাড়াও নিয়মিত ফিল্ড ভিজিটের সময় কর্মীদের অনজব সাপোর্ট প্রদান করা হয়েছে।
জেন্ডার ডায়ালগ ও জেন্ডার মার্কার ওরিয়েন্টেশনের সময় জেন্ডার মার্কারের পাশাপাশি ইউপিজি কর্মসূচির ৫টি জেন্ডার ইন্ডিকেটর- বিশেষ করে নিজের আয় ও পারিবারিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অপ্রচলিত পেশায় জীবিকা নির্বাহ এবং এই ইন্ডিকেটর দু’টি অর্জনের ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সহযোগিতার ক্ষেত্র কীভাবে প্রস্তুত করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি ইন্ডিকেটরগুলি অর্জন কারার লক্ষ্যে গ্রæপ ভিজিট ও হোম ভিজিটে অংশগ্রহনমূলক প্রক্রিয়ায় ৪টি জেন্ডার ইন্ডিকেটর বাস্তবভিত্তিক উদাহরণের সাহায্যে আলোচনার সম্ভাব্য কৌশলগুলো নিয়েও আলোচনা করা হয়। ফলশ্রæতিতে ইউপিজি কর্মসূচির কর্মীগন ইন্ডিকেটরগুলো গ্রæপ ভিজিট ও হোম ভিজিটে কার্যকরভাবে আলোচনা করার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করে ছিলেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় ফিল্ড পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনার ফলে আঁখি’র জীবনে যে পরিবর্তনের সূত্রাপাত হয় তা কর্মীদের নজরে আসে। আর আঁখি’র এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত ও টেকসই করার লক্ষ্যে ২৫ অক্টোবর ২০২২ তারিখে তার জীবনসঙ্গী হোসেন এর ভ‚মিকা কী হওয়া দরকার তা নিয়ে দু’জনের সাথে আলোচনা করার পাশাপাশি এবং গবাদি প্রাণী পালন ও কৃষি কাজের সঙ্গে আঁখি যদি ব্যবসা পরিচালনা করেন তাহলে তারা কীভাবে লাভবান হতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা করলে আঁখি ব্যবসা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং হোসেনও তাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করতে সম্মত হন। তারপর থেকেই নিয়মিত ভাবে আঁখি ও তার জীবনসঙ্গীকে ভিজিট/ফলোআপের প্রেষণা প্রদান অব্যাহত থাকে। বর্তমানে আঁখি বাজারে মুদি মালের দোকানের সাথে চা বিক্রয় করছেন এবং বেশ ভাল লাভবান হচ্ছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
বর্তমানে আঁখি’র ২টি গরু, ৫টি ছাগল, ৪টি রাজহাঁস, ৮টি মুরগী আছে এবং ১০ কাঠা জমি লীজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন। তিনি বলেন, একসময় যেসকল প্রতিবেশী তার ব্যবসা করা নিয়ে কটু কথা বলতো, ঠাট্রা-মশকরা করতো এখন তারাই তার দোকানের নিয়মিত ক্রেতা। আর এজন্য তিনি ইউপিজি ও জিজেডি কর্মসূচির প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শর্তহীনভাবে পাশে থাকার জন্য। তিনি মনেপ্রাণে বিশ^াস করতেন, ব্র্যাক তার পাশে থাকলে তার স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবেই। আর সেজন্যই তিনি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “ব্র্যাক হামার পাশত আছে, উখবে আমাক কে?”
আঁখি, বয়স: ৩৫ বছর
ঠিকানা: গ্রাম: ঘোষনগর, ডাকঘর: গগনপুর, উপজেলা: মহাদেবপুর, জেলা: নওগাঁ
অনুলেখক; স্বপন কুমার মিস্ত্রী ব্র্যাক জেলা সমন্বয়ক
কেইস স্টোরী সংগ্রহের তারিখ: ২৩ মে ২০২৩