• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন
  • Bengali Bengali English English
সংবাদ শিরোনাম
মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৩৪.৮৭ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবায় পাঁচ বছরে ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ: গবেষণা ৫০ হাজার মেট্রিক টন ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল রাজধানীর কড়াইল বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ২২০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না: জাতিসংঘ অবন্তিকার মৃত্যু; সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী আটক জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজে আরও জলদস্যু উঠেছে, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বিশিষ্টজন পাচ্ছেন স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪ গাজায় ইফতারের লাইনে দাঁড়ানো মানুষের উপর গুলি, নিহত ৬ শান্ত-মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের সহজ জয় জাহাজ অপহরণ ৫০ লাখ ডলার দাবি জলদস্যুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ হাইকোর্টের রমজানে খোলা থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

রাজশাহীর ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ : বাংলার প্রথম ইতিহাসভিত্তিক পত্রিকা

প্রজন্মের আলো / ২৪৬ শেয়ার
Update বুধবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২২

———————————————————————-
মো. সফিকুল ইসলাম
———————————————————————
১২২ বছর আগে আজকের দিনে (৫ জানুয়ারি) রাজশাহী মহানগর থেকে প্রকাশ হয়েছিল `ঐতিহাসিক চিত্র’। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক চিত্রই ইতিহাসভিত্তিক বাংলার প্রথম ত্রৈমাসিক পত্রিকা। বাংলার ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় নিজ সম্পাদনায় এই পত্রিকা প্রকাশ করে বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঐতিহাসিক চিত্রের প্রধান সারথী।
১৮৯৯ সালে ৫ জানুয়ারি (২২ পৌষ, ১৩০৫) ঐতিহাসিক চিত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। রাজশাহী মহানগরীর ঘোড়ামারায় অবস্থিত অক্ষয়কুমারের বাসভবন ‘অক্ষয় নিকেতন`-এ পত্রিকাটির কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এবং এখান থেকেই প্রকাশ হতো। ছাপাও হয়েছে রাজশাহী থেকে। অক্ষয়কুমারের অনুরোধে কবিগুরু ঐতিহাসিক চিত্রে’র প্রথম সংখ্যায় `সূচনা’ নামে ভূমিকা লিখে দেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় আত্মকথায় লিখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী` পত্রের সম্পাদনারভার গ্রহণ করিলে (১৩০৫), তাঁহার সহায়তায় এবং তাঁহার প্রস্তাবে, ঐতিহাসিক চিত্র নামক ত্রৈমাসিক পত্রের সম্পাদনভার গ্রহণ করি`(অক্ষয়কুমারের `আত্মকথা’, শ্রীহরিমোহন মুখোপাধ্যায় রচিত বঙ্গভাষী কার্যালয়, কলিকাতা হতে ১৯০৪ খ্রি. প্রকাশিত `বঙ্গভাষার লেখক’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে)।
প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধানে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের উৎসাহ ছিল সীমাহীন। প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও সেজন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করার ব্রত নিয়ে তিনি ঐতিহাসিক চিত্র প্রকাশ করেন।
অক্ষয়কুমার অভিমত, `ইতিহাসের উপাদান সঙ্কলিত না হইলে, ইতিহাস সঙ্কলিত হইতে পারে না ; —তাহা বহুব্যয়সাধ্য, বহুশ্রমসাধ্য, বহুলোকসাধ্য ; —এ কথা বঙ্গসাহিত্যে পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাকেই একমাত্র অন্তরায় বলিয়া নিশ্চিন্ত হইবার উপায় নাই। কিরূপ বিচার-পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা কর্ত্তব্য, তদ্বিষয়ে সংকীর্ণতার অভাব নাই। ন্যায়নিষ্ঠ বিচারপতির ন্যায় সত্যোদ্ঘাটনের চেষ্টাই যে ইতিহাস-লেখকের প্রধান চেষ্টা’ (‘উপক্রমণিকা’, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, গৌড়রাজমালা, বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি, ১৯১২ খ্রি., রাজশাহী)।
সাহিত্যিক প্রসেনজিৎ সিং বলেন, ‘উনিশ শতকের শেষদিকে অক্ষয়কুমার ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১-১৯৪১) পরস্পরের মনের কাছাকাছি ছিলেন। …কিন্তু এঁদের মিলন একটি স্থানে কেন্দ্রায়িত হল। একটি অভিজাত শিক্ষিত মনের যুক্তিবাদী স্বদেশচিন্তা। এই স্বদেশচিন্তা-বৃক্ষের দু`টি ফুল। একটি রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সাধনা পত্রিকা অন্যটি অক্ষয়কুমার সম্পাদিত এবং রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ঐতিহাসিক চিত্র (১৮৯৯) নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা’ (‘রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসপ্রিয়তার সঙ্গী ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়`, প্রসেনজিৎ সিং, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সার্ধশতজন্মবার্ষিকী ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক- খোন্দকার সিরাজুল হক, প্রকাশক- মুহাম্মদ লুৎফুল হক, ১ মার্চ ২০১৩, রাজশাহী)।
বাংলাভাষায় আধুনিক ইতিহাসচর্চার প্রয়াস শুরু হয় ইংরেজ আমলা ও ইতিহাসবিদদের হাত ধরে। তবে, কেবলমাত্র ইতিহাসকে বিষয় করে কোনো পত্রিকা তখন পর্যন্ত প্রকাশ ঘটেনি। এ ব্যাপারে প্রথম এগিয়ে আসেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁর ‘ঐতিহাসিক চিত্র` নিয়ে।
ঐতিহাসিক চিত্রের জন্মসূচনার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ও প্রভাব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত-রচয়িতা শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘সাহিত্যেও যেমন ইতিহাসের ক্ষেত্রেও বাংলা দেশে তেমনি আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চলিতেছিল। ইহার সূত্রপাত করেন পরলোকগত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রস্তাবে তিনি `ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রকাশ করেন’ (শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৯৩৩, পৃ. ৩৫৫)।
অক্ষয়কুমারের প্রথমে ইচ্ছে ছিল একটি সভাস্থাপন করা। এই অভিপ্রায় রবীন্দ্রনাথকে জানালে রবীন্দ্রনাথ পত্রিকা প্রকাশের পক্ষে মত দেন, অক্ষয়কুমার বন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অক্ষয়কুমার নিজেই পত্রিকার নাম `ঐতিহাসিক চিত্র’ রেখে প্রকাশে এগিয়ে যান । আবির্ভাবের আগে পত্রিকাটির উদ্দেশ্যে ও আদর্শ নিয়ে একটি প্রস্তাবপত্র মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্রে প্রেরণ করেন অক্ষয়কুমার, এই প্রস্তাবপত্রকে তখন `অনুষ্ঠানপত্র’ বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ভারতী পত্রিকার সম্পাদক। এই প্রস্তাবপত্রটি অক্ষয়কুমার ‘ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ` নামে ভারতী পত্রিকায় মুদ্রণের জন্য প্রেরণ করেন। রবীন্দ্রনাথ `ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ’ ভারতীতে মুদ্রণ করেন এবং সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র আলোচনা লিখে দেন’ (প্রসঙ্গকথা, ভারতী, ভাদ্র ১৩০৫, পৃ-৪৭৬-৪৭৭)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গকথা-য় অক্ষয়কুমারকে ‘আধুনিক বাঙ্গালী ইতিহাস-লেখকগণের শীর্ষ-স্থানীয়` আখ্যা দিতে দ্বিধা করেননি। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখে কবিগুরু বলেন, `পরের মুখে নিজেদের কথা না-শুনে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার এবার বুঝি সম্ভব হবে। হৌক বা না-হৌক আমাদের ইতিহাসকে আমরা পরের হাত থেকে উদ্ধার করিব। …আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা স্বাধীন দৃষ্টিতে দেখিব, সেই আনন্দের দিন আসিয়াছে। …উপযুক্ত সম্পাদক উপযুক্ত সময়ে এ কার্যে অগ্রসর হইয়াছেন ইহা আমাদের আনন্দের বিষয়’ (প্রসঙ্গকথা, ভারতী, ভাদ্র ১৩০৫, পৃ-৪৭৬-৪৭৭)।
রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার নিবিড়বন্ধুত্বে বহু গুণকাজ একসাথে করেছেন। বটবৃক্ষের মত এক অপরের ছিলেন ছায়াসঙ্গী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই ছায়ারই ফসল ঐতিহাসিক চিত্র। বিখ্যাত ছড়াকার শিল্পী উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (ছড়াকার সুকুমার রায়ের পিতা ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দাদা) ছিলেন ‘ঐতিহাসিক চিত্র`র প্রচ্ছদ শিল্পী। রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারায় অবস্থিত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের বাস ভবন ‘অক্ষয় নিকেতন`-এ ঐতিহাসিক চিত্রের কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এবং এখান থেকেই প্রকাশ হতো। ঐতিহাসিক চিত্র ছাপাও হয়েছে রাজশাহী থেকে।
বাংলাভাষায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে প্রকাশিত বাংলা সাময়িকী হিসেবে তখনকার পণ্ডিত সমাজে ঐতিহাসিক চিত্র সমগ্র বাংলায় সমাদৃত হয়। ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ঐতিহাসিক চিত্র প্রসঙ্গে বলেন, `বাংলা ভাষায় এইরূপ চেষ্টা এই প্রথম’ (ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভারতকোষ, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা, ১৯৬৪)।
অক্ষয়কুমারের জীবনের শ্রেষ্ঠ দুই সাহিত্যগুরু অক্ষয়কুমার দত্ত ও সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঐতিহাসিক চিত্রের প্রথম সংখ্যার ‘সম্পাদকের নিবেদন` নামক সম্পাদকীয়তে গভীর অনুরাগে জ্ঞান করেছেন। বাঙালি জাতি তথা মাতৃভূমির ইতিহাস না থাকা বা ইতিহাসচর্চার সঙ্কট নিয়ে তাঁদের অভিমত একাধিকবার উল্লেখ করে নিজের কথা বলেছেন।
সম্পাদকীয়তে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সাবলিলভাবে উল্লেখ করেন যে, ‘ঐতিহাসিক চিত্রে কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বিশেষের মুখপত্র হইবে না, ইহা সাধারণত ভারতবর্ষের এবং বিশেষত বঙ্গদেশের, পুরাতত্ত্বের উপকরণ সংকলনের জন্যই যথাসাধ্য যত্ন করিবে। সে উপকরণের কিয়দংশ যে পুরাতন রাজবংশে ও জমিদার বংশেই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব, তাহাদের সহিত এদেশের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সংশ্রব। সুতরাং, প্রসঙ্গক্রমে তাহাদের কথারও আলোচনা করিতে হইবে। যাঁহারা আধুনিক রাজা বা জমিদার তাঁহাদের কথা নানা কারণে ভবিষ্যতের ইতিহাসে স্থান প্রাপ্ত হইবে। সে ভার ভবিষ্যতের ইতিহাস-লেখকের হস্তে রহিয়াছে। ঐতিহাসিক চিত্র-র সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই¾পুরাতত্ত্ব সংকলন করাই ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য’ (সম্পাদকেন নিবেদন, ঐতিহাসিক চিত্র, ৫ জানুয়ারি ১৮৯৯, রাজশাহী)।
অক্ষয়কুমারের ঐতিহাসিক চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইতিহাস চেতনাকেও প্রভাবিত করেছে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত রচয়িতা শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অভিমত, ‘ঐতিহাসিক চিত্রের প্রকাশকালে (১৮৯৯) রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তও যে তৎকালীন ঐতিহাসিক চেতনার প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পাই তাঁর `কথা’ কাব্যে।
উক্ত গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই যে ১৮৯৯ সালের রচনা তা নিতান্তই আকস্মিক নয়। কথা কাব্যের সব কবিতাই কোন না কোন ঐতিহাসিক সূত্র অবলম্বনে রচিত, এটাই সব চেয়ে বড় কথা নয়। ভারতবর্ষের বহু প্রদেশে ও ভারত-ইতিহাসের বহু যুগের ইতিহাস এই গ্রন্থের উপাদান জুগিয়েছে। সবগুলি কবিতাকে একত্র করে দেখলেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের কবিদৃষ্টিও দেশে এবং কালে কত দূরপ্রসারী ছিল। কথা কাব্যে ও ঐতিহাসিক চিত্রের মধ্যে যে একটি সূহ্ম যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল তার একটি পরোক্ষ প্রমানও পাওয়া গিয়াছে। উক্ত ঐতিহাসিক পত্রিকায় ‘চাঁদ কবির বীরগাথা’ নামে একটি প্রবন্ধ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধের প্রথম কিস্তির শেষে এইরূপ ‘মন্তব্য` ছিল। —কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় চাঁদ কবির বীরগাথা বাঙ্গলায় কবিতানিবন্ধ করিবার ভার গ্রহণ করিয়াছেন ; তাহা যথাকালে প্রকাশিত হইবে’ (শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৯৩৩)।
গবেষণামূলক রচনা সুসঙ্গতভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারে ঐতিহাসিক চিত্র`র ভূমিকাই বাংলা ভাষায় প্রথম। ঐতিহাসিক চিত্র’তে নিত্যনৈমিত্তিক গবেষণাকর্ম ছাড়াও প্রতœতাত্ত্বিক বিষয়াবলি প্রকাশে গুরুত্ব পেতো বেশি। স্থানীয় ইতিহাস রচনার উপকরণসমূহ সংগ্রহ করে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরা হতো, এতে করে সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে পত্রিকাটি সমাদৃত হয়।
ঐতিহাসিক চিত্রে লেখা পরিবেশনে নবীন প্রবীণের সমন্বয় ঘটেছিল। ফলে সৃজনশীল লেখক তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পত্রিকাটির। প্রথম সংখ্যার সূচি ছিল এরকম : ‘সূচনা` শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, `সম্পাদকের নিবেদন’ শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘ইন্ডিকা` শ্রীভবানীগোবিন্দ চৌধুরী, `রিয়াজ-উস-সালাতিন (উপক্রমণিকা)’ শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘মল্লভূমি` শ্রী শশিভূষণ বিশ্বাস, `নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসন’ প্রসন্ননারায়ণ চৌধুরী, ‘জগৎশেঠ` শ্রীনিখিলনাথ রায়, `চাঁদকবির বীরগাথা’ শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘আকবর শাহ` শ্রীহরিসাধন মুখোপাধ্যায়, `পৌরাণিকী’ শ্রীরজনীকান্ত চক্রবর্তী।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছিল তা আরও প্রগাঢ় হয়েছিল ঐতিহাসিক চিত্রকে ঘিরেই। অক্ষয়কুমার নিয়মিত কবিগুরুর সাথে যোগাযোগ রাখতেন, কবিগুরুও তাঁকে সাদরে আপ্যায়ন করতেন। সে-সময়ে ঠাকুরবাড়িতে যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাঁদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন অন্যতম। ঐতিহাসিক চিত্রকে নিয়ে কবিগুরুর সাথে অক্ষয়কুমারের একাধিক পত্রালাপ রয়েছে।
কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মকথায় বলেন, ‘রাজশাহি থেকে ঐতিহাসিক অক্ষয় মৈত্রেয় মহাশয় বাবার কাছে মাঝে মাঝে আসতেন। অগাধ তাঁর পাণ্ডিত্য, কিন্তু তাঁর মধ্যে একটুও শুষ্কতা ছিল না। তিনি যখন বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা বলতেন, গল্পের মত ফুটে উঠত চোখের সামনে পুরোনো ইতিবৃত্তের কথা। বাবার সঙ্গে ইতিহাস ছাড়াও নানা বিষয়ে আলোচনা হত, যা থেকে তাঁর মনের গভীরতার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যেত` (পিতৃস্মৃতি, সংস্করণ- ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮, প্রকাশক- জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, পৃ. ৩১-৩২)।
ঐতিহাসিক চিত্রের সূচনা লিখবার জন্য সম্পাদক অক্ষয়কুমার তাঁর বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচন করা প্রসঙ্গে অভিমত দিয়েছেন ইতিহাসবিদ প্রসেনজিৎ সিং। তিনি বলেন ‘—এটি কিন্তু কেবলমাত্র বন্ধুপ্রিয়তাই নয়। তিনি জানতেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একজন খাঁটি ইতিহাসজ্ঞ লুকিয়ে আছে’ (`রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসপ্রিয়তার সঙ্গী ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়`, প্রসেনজিৎ সিং, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সার্ধশতজন্মবার্ষিকী ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক- খোন্দকার সিরাজুল হক, প্রকাশক- মুহাম্মদ লুৎফুল হক, ১ মার্চ ২০১৩, রাজশাহী)।
সূচনা’য় কবিগুরু ঐতিহাসিক চিত্র-কে `আমাদের স্বাস্থ্য—আমাদের প্রাণ’ বলে আখ্যায়িত করেন। গভীর উচ্ছ্বাসে ‘সূচনা`য় রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, `ঐতিহাসিক চিত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি স্বদেশী কারখানাস্বরূপ খোলা হইল। এখনো ইহার মূলধন বেশী জোগাড় নাই, ইহার কলবরও স্বল্প হইতে পারে, ইহার উৎপন্ন দ্রব্যও প্রথম প্রথম কিছু মোটা হওয়া অসম্ভব নহে, কিন্তু ইহার দ্বারা দেশের যে গভীর দৈন্য, যে মহৎ অভাব মোচনের আশা করা যায়, তাহা বিলাতের বস্তা বস্তা সূক্ষ্ম ও সুনির্মিত পণ্যের দ্বারা সম্ভবপর নহে।’ (সূচনাটি রবীন্দ্র-রচনাবলী নবম খণ্ডে আধুনিক সাহিত্য অংশে এবং ইতিহাস গ্রন্থে সংকলিত।)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর`সূচনা’য় পত্রিকাটির দীর্ঘায়ু কামনা করে বলেছিলেন, ‘আশা করি যে, এই পত্র আমাদের দেশে ঐতিহাসিক স্বাধীন চেষ্টার প্রবর্তন করিবে। …সেই চেষ্টাকে জন্ম দিয়া যদি ঐতিহাসিক চিত্র চিত্রের মৃত্যু হয়, তথাপি সে অমর হইয়া থাকিবে` (সূচনা, ঐতিহাসিক চিত্র, প্রথম সংখ্যা-, রাজশাহী, ৫ জানুয়ারি ১৮৯৯)।
একবছরে চারটি সংখ্যা প্রকাশের পর অর্থের অভাবে অক্ষয়কুমারের ঐতিহাসিক চিত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত জীবনকাল হলেও স্থানীয় ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে ঐতিহাসিক চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিক চিত্র তখনকার বঙ্গীয় সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
ঐতিহাসিক চিত্র, দ্বিতীয় পর্যায়ে ইতিহাসবিদ নিখিলনাথ রায় সম্পাদনায় মাসিক হিসেবে প্রকাশ শুরু করেন, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই প্রকাশনা হয় ভাদ্র ১৩১১ থেকে ১৩১২ শ্রাবণ পর্যন্ত (১৯০৪-১৯০৫), তখনকার ঐতিহাসিক চিত্র কলিকাতার মেটক্যাফ প্রেস থেকে ছাপা হতো। আবার বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় নিখিলনাথ রায় কর্তৃক তৃতীয় পর্যায়ে ঐতিহাসিক চিত্র প্রকাশ হয় বৈশাখ ১৩১৪ (১৯০৭) থেকে। এবার চলে চৈত্র ১৩১৮ (১৯১২) পর্যন্ত ; —এরপর আবার বন্ধ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ঐতিহাসিক চিত্রে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের নিয়মিত লেখার কারণে মনে করা হয় যে পত্রিকাটির প্রতি অক্ষয়কুমারের অনুরাগ বর্তমান ছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের নিকট থেকে নিখিল রায় বুদ্ধিভিত্তিক পরামর্শ লাভ করতেন বলে মনে করা হয় ।
বাংলার ইতিহাসচর্চায় অক্ষয়কুমারের ঐতিহাসিক চিত্রের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে সাহিত্যিক প্রবোধচন্দ্র সেন বলেন, `ঐতিহাসিক চিত্রের মৃত্যু হয়েছে, তথাপি সে লোকত্রয় জয় করে অমর হয়েছে। …ইদানীং কালে (১৯৫০) বঙ্গীয় ইতিহাসপরিষদ্ `ইতিহাস’ নামে যে ত্রৈমাসিক পত্র প্রকাশ করেছেন, অর্ধ শতাব্দীরও পূর্বে ঐতিহাসিক চিত্রই তার পথনির্মাণে ব্রতী হয়েছিল, একথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। …এক পর্বে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যে প্রেরণা দিয়েছিলেন, তার পরবর্তী পর্বে তাতে শক্তি যোগালেন রবীন্দ্রনাথ। ঐতিহাসিক চিত্রে এই দুই সাহিত্যরথীর ইতিহাস-প্রেরণার একত্রে সমাবেশ ঘটেছিল` (বাংলার ইতিহাস-সাধনা, জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৫ ভাদ্র ১৩৬০, পৃ. ৩৯-৪০)।
স্মরণযোগ্য যে, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের জন্ম ১৮৬১ সালের ১ মার্চ, মুত্যু ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০।
প্রখ্যাত লেখক শ্রীভবানীগোবিন্দ চৌধুরী যথার্থই বলেন, `রাজসাহীতে যাহা কিছু অক্ষয়, তাহাতেই অক্ষয়কুমার ছিলেন’ (ভারতবর্ষ, ‘অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়`, বৈশাখ, ১৩৩৭, পৃ. ৮২৫)। রাজশাহীর যে-সকল গৌরবদীপ্ত সন্তান তাঁদের বহুমুখী কর্মপ্রতিভা ও পাণ্ডিত্য দিয়ে বরেন্দ্রভূমি, সমগ্র বাংলা, ভারতবর্ষ, এমনকি বিশ্বব্যাপি নন্দিত হয়েছেন তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।
লেখক : উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও সংবাদ

Categories