খোরশেদ আলম রাজুঃ*
কিশোরী ফেলানী থেকে স্বর্ণা দাশ চা শ্রমিক গোপাল থেকে পারভেজ,বাঙালী বৃদ্ধ বণিতা সহ কোমলমতি শিশু কিশোরদের প্রাণ কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র মায়া করেনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। কেউ বিপদে পড়লে বাঁচার আঁকুতিতে চিৎকার দেয়,বেড়িয়ে আসে অগনিত সাহায্যের হাত। আবার কারো চিৎকার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারী সমালোচনার শীর্ষে থাকা,১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনের কাঁটাতারে ঝুলন্ত নিথর দেহ। মেয়েকে বিয়ে দিতেই বাবা নাগেশ্বর নয়াদিল্লি থেকে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর দিনহাটা সীমান্তের কাঁটাতার টপকিয়ে আসতে চেয়েছিল নিজ মাতৃভুমি বাংলাদেশে। বাবা নাগেশ্বর এপারে আসতে পারলেও মেয়ে ফেলানী বিয়ের পিরিতে বসার বুকভরা স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন ২০১৩ সালের ১৩ আগষ্ট ভারতের কোচবিহার জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে মামলা শুরু হলেও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে প্রহসনের বিচারে নির্দোষী প্রামানিত হয় প্রধান আসামী অমিতাব সহ দোষী বিএসএফ সদস্যরা।
তৎকালীন ভারতের কংগ্রেস সরকার রাজীবগান্ধীর সময়কালে সীমান্তের নিরাপত্তায়,“কাঁটাতার” চোরাচালান আর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যতটা ভুমিকা রেখেছে তার চেয়ে বেশী পরিমান নির্মমভাবে মানুষ হত্যার মত জঘন্য অপরাধে দায়িত্ব পালন করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। উইকিপিডিয়ায় উল্লেখিত একটি পরিসংখ্যান স্পষ্ট বলে দেয়,কাঁটাতারের পূর্বে ও পরের পরিস্থিতি কেমন ছিল। সীমান্তের নিরাপত্তায় কাঁটাতার নির্মানের পূর্বে ১৯৭২ সাল হতে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তথা ১৮ বছরে সীমান্তে মোট ৩৩৮ জন নিহত হয়েছে। আসাম শান্তি চুক্তির পর ১৯৮৯ সাল থেকে কাঁটাতারের বেঁড়া দেওয়া শুরু হয় তবে পূর্ণাঙ্গ শেষ না হলেও এরই মাঝে ১৯ বছরে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ১১১৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিসী কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য মতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সীমান্তে নিহত সংখ্যা ৬০৭ জন। এখন বলতেই হয়,সীমান্তের কাঁটাতার চোরাচালান আর অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ফাঁদ,না শুধুমাত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের মারার (মৃত্যু) ফাঁদ?
সাম্প্রতিক সময়ে নওগাঁর ধামুইরহাট বস্তাবর সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক কাঁটাতারের বেঁড়া দেওয়ার চেষ্টা,চাপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফের ব্্রাংকার নির্মান ও গাছকাটার চেষ্টা,লালমনিরহাট পাটগ্রাম সীমান্তে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেঁড়া দেওয়ার চেষ্টা,সিলেটের বিয়ানী বাজারের গোঁজকাটা সীমান্ত এলাকায় প্রায় দু’শ বছরের পুরানো মসজিদ পূর্ণনির্মানে বাঁধা। সকল কিছুই আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন উপেক্ষা করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বুক উচু করেই বলতে হয় ভারতের সকল অপচেষ্টাকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও সংগ্রামী জনতা। এই সময়ে এসে যদি ভারত মনে করে,বাংলাদেশ আয়তনে ক্ষুদ্র,নেই কোন নামীদামী যুদ্ধ সরঞ্জাম,তাহলে ভুল করবে। বাঙালী বীরের জাতি ভুখন্ডের আয়তন ছোট হলেও হৃদয়ে সঞ্চিত মনোবল অনেক বৃহৎ। বাঙালী একমাত্র সেই জাতি,যে জাতি মাতৃভাষার জন্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করেছে। বাঙালী সেই জাতি,১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়,স্বাধীন ভুখন্ডে উড়িয়েছে লাল সবুজের কেতন।
বর্তমান সময়ে এসে কেউ যদি এই বীরত্বগাঁথা জাতির সাথে পায়ে পা দিয়ে বিবাদ করতে চায় তাহলে প্রথমে ছাড় দিলেও ছেড়ে দিবেনা। তার জলন্ত উদাহরণ,সাম্প্রতিক সময়ে চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে কাঁটাতারের ঘটনায় এক সাধারণ কৃষক বিজিবির ব্্রাংকারে দেশীয় অস্ত্র (হাসুয়া) হাতে ওতপেতে শত্রু মোকাবেলায় প্রস্তুুত থাকার দৃশ্য গনমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের সংগ্রামী কন্ঠ বলে দেয়,আমার দেশের ১ ইঞ্চি মাটিও দখল করতে দিবনা এতে জীবন দিতেও রাজি।
সীমান্তে শুধু হত্যার মত জঘন্য অপরাধ করেই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ক্ষান্ত নেই। ধর্ষন ছিনতাই সহ আরও নানা অপরাধে লিপ্ত,যা কয়েকটি মাধ্যমের তথ্য মতে বিস্তারিত পরিসংখ্যানে উঠে আসে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে কালের কন্ঠের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিসী কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যানে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ ইং সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফ এর গুলিতে ৬ শতাধিক তথা ৬০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অধিকার নামে এক মানবাধিকার সংস্থার মতে ১৫ বছরে বিএসএফ এর গুলিতে ৫৮২ বাংলাদেশী নিহত হয় এবং ৭৬১ জন আহত হয়। উইকিপিডিয়াই “বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে হত্যা” শিরোনামে ছক আকারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সীমান্তে মোট হত্যা ১৮৬০ জন,আহত হয়েছে ১১৪৫ জন,অপহৃত হয়েছে ১৪০৮ জন,নিখোঁজ হয়েছে ১১১ জন,ধর্ষনের স্বীকার হয়েছে ১৫ জন,ছিনতাই এর স্বীকার হয়েছে ১৭৫,পুশইন হয়েছে ৩৫৪ এবং অন্যান্য অপরাধ সংগঠিত হয়েছে ৩৪ টি। ২০০৬ সালে বিএসএফ সবচেয়ে বেশী হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে যার সংখ্যা দেড়শতাধিক তথা ১৫৫ জন।
সীমান্তে আর কত প্রাণ কেড়ে নিলে থামতে পারে পাষান্ড সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ?
আর কতটা নিখোঁজ,ছিনতাই,ধর্ষণ সহ নির্মম হত্যাকান্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সীমান্তরক্ষী নামের খুনি বাহিনী। যখনই সীমান্তে হত্যা নিয়ে দেশ বিদেশের গনমাধ্যমে হৈচৈ পড়ে ঠিক তখনই দু’দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠকে ভুল স্বীকার করে সীমান্তে হত্যা না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা শুধুই নাটকীয় সংলাপ ছাড়া আর কিছুই না। বরং দিনদিন দু’দেশের সীমান্তের কাঁটাতার উপেক্ষা করে মানব পাচার,জাল নোট আদান প্রদান,গবাদিপশু পারাপার,অস্ত্র সহ মাদক চোরাকারবারি দিনদিন বেড়েই চলছে। তাহলে সীমান্তের নিরাপত্তাই কাঁটাতার কতটা নিরাপদ এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই।
আন্তর্জাতিক সীমা রেখা বা (আইবি) বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার একটি সীমানা রেখা। যে রেখার মধ্যে ৪,১৫৬,৫৬ কিঃমিঃ বা (২,৫৮২) মাইল দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা যা বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম ভুমি সীমানা হিসেবে উল্লেখিত। এই সীমানার আওতায় বাংলাদেশের ৮ টি বিভাগ এবং ভারতের কিছু রাজ্য অন্তর্ভুক্ত। ১৯৪৭ সালে ১৭ আগষ্ট স্যার র্যাডক্লিফ এর নেতৃত্বে ভুমি নিরপেক্ষ দ্বিখন্ডিত সীমারেখা নির্ধারিত হয়। এই সময়টিতে সীমানা নির্ধারিত হলেও কোন কাঁটাতার ছিল ন্ াতবে দু’দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন বিদ্যমান থাকলেও বর্তমান সময়ের মত নির্মম হত্যা সহ অন্যান্য অপরাধ এতটা সংগঠিত হয়নি যা উপরে উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান। অবাধে গবাদিপশুর বিচরণ অনুপ্রবেশ আর চোরাচালান ঠেকাতে,৩৮ বছর পর ১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার আর আসামের সেভেন সিষ্টার গুলোর মধ্যে আসাম শান্তিচুক্তি হয়। এর এক বছরের মধ্যেই ভারত সরকার পার্লমেন্টে ঘোষনা করেন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়ার। তৎকালীন সময়ে ভারতের কংগ্রেস সরকার রাজীব গান্ধী এবং বাংলাদেশে সামরিক শাসনে জেনারেল এরশাদ। ভারতের পার্লমেন্টে ঘোষনা বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৯ সালে কাঁটাতার বসানোর কাজ শুরু হয়। তবে কিছুকিছু জায়গায় নানা কারনে কাঁটাতার দেওয়া সম্ভব হয়নি। সীমান্তে যে উদ্দেশ্যে কাঁটাতার দেওয়া হয়েছে সে উদ্দেশ্য কতটা সফল এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বিশেজ্ঞদের।
টানা তিন মেয়াদে থাকা ক্ষমতাশীল দল আওয়ামীলীগের পতন হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়কালেও চোরাচালান সহ সীমান্তে হুলি খেলার মত নির্মম হত্যাকান্ড সহ নানা অপরাধ দমিয়ে রাখতে পারেনি। আলোচিত কোন ঘটনা ঘটলেই দু’দেশের মধ্যে বড় আয়োজনে পতাকা বৈঠকে বিচার প্রার্থীদের আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনদিন আশার আলো দেখা দেয়নি। নেওয়া হয়না হত্যা বন্ধে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা। ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুথানে পতন হওয়া ফ্যাসিষ্ট সরকার পালিয়ে যায় ভারতে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয় ড.মুহাম্মদ ইউনুস। এ সময়েও থেমে নেয় হত্যাকান্ড। বরং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে নতুন করে দেখা দিয়েছে শুন্যরেখা হতে ১৫০ গজ জায়গা দখলে বিএসএফের বেপরোয়া দৈরাত্ম। এমন সময়ে কাটাতারের দখল কি ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশকে? হঠাৎ করে ভারতের স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেন এত মিথ্যা প্রচারণায় ব্যস্ত। এতদিন পর সীমান্তে কেন এত থমথমে অবস্থ্ া। এই খেলার নেপথ্যে কে রয়েছে? বাংলাদেশী নাগরিকরা ঠিকই সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়েছে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। অতীতের ইতিহাস আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ইসুকে কেন্দ্র করে সীমান্তে যে ষড়যন্ত্র চলছে তা যদি সঠিক সিদ্ধান্তে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তাহলে অতীতের চেয়ে আরও ভয়ংকর রূপ দেখা দিতে পারে বলে ধারণা বিশেজ্ঞদের।
* লেখক ও সাংবাদিক