অধ্যাপক দেওয়ান নূরুল হক
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবী করীম সা. ছিলেন দুস্থদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। তিনি নিজেই পাহাড়সম কষ্ট, দুঃখ, শোক ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। আর সেজন্য দরিদ্র ও ব্যথিতদের দুঃখ-কষ্ট ও মনোবেদনা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। তিনি যখন লোকদের কাছে দীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করছিলেন, তখন যারা তাঁর ওই দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল দুস্থ, দরিদ্র, দুর্বল, শোষিত ও অত্যাচারিত।
সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মহান আল্লাহই ভালো জানেন, দুনিয়ার মানুষ কীসে শান্তি পেতে পারে এবং কীসে তাদের অশান্তি হতে পারে। তারা যেন এ দুনিয়ায় সুখ-শান্তি পায় এবং আখিরাতে নাজাত পায়, তার ব্যবস্থাও তিনিই করেছেন। আর সেজন্যই তিনি আখেরি নবী সা.-কে রহমতস্বরূপ দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে লোকেরা)! তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছে। যেসব বিষয় তোমাদের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলোতে সে মনোকষ্ট পায়। সে তো তোমাদের কল্যাণকামী।’ তাওবা : ১২৮।
মহান আল্লাহ নবী সা.-কে এমন কতকগুলো বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন, যেগুলোর সাহায্যে তিনি যেন দুনিয়ার সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে পারেন এবং তাদের সকলের হক সংরক্ষণ করতে পারেন।
নবী করীম সা. তাঁর দুধমাতা হজরত হালিমা রা.-এর দুধপানের সময় শুধু তাঁর ডান স্তন থেকে দুধপান করতেন। বাম স্তনে মুখ দিতেন না। সেটি তাঁর দুধভাই হজরত আবদুল্লাহর রা.-এর জন্য রেখে দিতেন।
সুতরাং এখান থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবেই নবীজি সা.-কে ন্যায়পরায়ণ করেছিলেন। আগামীতে নবুয়্যত লাভ করার পর তিনি যেন মুসলিম-অমুসলিম, পুরুষ-মহিলা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ধনী-দরিদ্র, শাসক-শাসিত ইত্যাদি বিভিন্ন সম্পর্কের লোকদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে পারেন, মহান আল্লাহ এ সৎ গুণটি তাঁকে তাঁর জন্মের সময়ই দান করেছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত আমরা আমাদের সমাজে নবীজি সা.-এর আদর্শের বাস্তব রূপ দিই না। সমাজের লোকদের যার যা হক রয়েছে, তা আদায় করি না। অসহায়, গরিব ও বঞ্চিতদের আমরা যা দিই, তা ভিক্ষা হিসেবে দিই। তাদের ন্যায্য পাওনা হিসেবে দিই না।
নবীজি সা. বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে ব্যক্তি পেটপুরে খায় আর তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (বায়হাকী, মিশকাত)।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা [তোমাদের সমাজে] দীনকে প্রতিষ্ঠা কর। আর এ ব্যাপারে দলাদলি ও মতভেদে লিপ্ত হয়ো না।’ (আশ শূরা : ১৩)।
উপরিউক্ত হাদিস ও আয়াত থেকে বোঝা গেল, একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে একধিক ধর্মের লোক থাকতে পারে, যারা সেখানে শান্তির সাথে বসবাস করবে। আর কারো প্রতিবেশী হিসেবেও বিভিন্ন জাতির লোক থাকতে পারে, যাদের কেউ অভুক্ত ও অভাবী থাকার কথা নয়।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, নবীজি সা. একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন, যা ছিল সকলের জন্যই কল্যাণকর। আর তিনি নিজে দীর্ঘ দশ বছর যাবত ওই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। জানা যায়, ওই রাষ্ট্রের লোকেরা প্রথম দিকে অত্যন্ত গরিব ছিল। আর কিছুদিনের মধ্যেই তারা সচ্ছল হয়েছিল। এমনকি পরবর্তী সময় ওই রাষ্ট্রে জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যেত না।
আমরা মুসলমানরা যদি নবী সা.-এর আদর্শ পুরোপুরি অনুসরণ করতাম এবং মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করতাম, তাহলে দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের কথা বা অন্য কোনো তন্ত্র অর্থাৎ জীবন ব্যবস্থার কথা কেউ একবারও মুখে নিত না।
নবী পাক সা. অসহায়দের প্রতি কী রকম দয়ালু ছিলেন, এখানে সে সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি অমূল্য বাণী উল্লেখ করা হলো।
১. নবী সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কারো অভাব পূরণ করবে, এতে তার উদ্দেশ্য হলো, সে ওই ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করবে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে সে যেন আমাকেই সন্তুষ্ট করল। আর যে ব্যক্তি আমাকে সন্তুষ্ট করল, প্রকৃতপক্ষে সে যেন আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল, আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। (বায়হাকী ও মিশকাত)।
২. নবীজি সা. বলেছেন, ‘আমি [মিরাজের রাতে] জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, যারা তাতে প্রবেশ করেছে, তাদের অধিকাংশই গরিব-মিসকিন। আর বিত্তবানরা [হিসাবের দায়ে] আটকা পড়ে আছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
৩. নবী পাক সা. বলেছেন, ‘গরিবরা ধনীদের পাঁচশ বছর পূর্বে বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর সেটা [ওই সময়ের পরিমাণ] হবে কিয়ামত দিবসের অর্ধদিন। (তিরমিযী ও মিশকাত)।
৪. রাসূল পাক সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিমের ওপর নিপীড়ন চালাবে অথবা তার অধিকার খর্ব করবে অথবা তার ওপর শক্তির অতিরিক্ত কোনো বোঝা চাপিয়ে দেবে অথবা তার কোনো জিনিস জোরপূর্বক নিয়ে নেবে, আমি [কিয়ামতের দিন] আল্লাহর আদালতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত মামলায় অমুসলিমদের পক্ষে উকিল হিসেবে দাঁড়াব।’ (আবু দাউদ, রাহে আমল)।
উল্লেখিত হাদিসগুলোর ওপর একটু চিন্তা করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে, আমরা নবী করীম সা.-এর আদর্শ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি।
আমরা আমাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি এবং কী পরিমাণ এড়িয়ে চলছি, সেটা অনুভব করা আমাদের সকলেরই একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশীদের এবং সমাজের সকল শ্রেণির লোকদের কে কেমন অবস্থায় আছে, কেউ করোনায় বা অন্য কোনো রোগে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের লোকদের খোঁজখবর নেওয়া আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
আমরা যেমন নবী করীম সা.-এর আদর্শ নামাজ, রোজা, হজ বা এরকম কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি অনুসরণ করি। তাঁর জীবনের অন্যান্য আদর্শও সেরকমভাবে অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে প্রিয়নবী সা.-এর পূর্ণ আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।