• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন
  • Bengali Bengali English English
সংবাদ শিরোনাম
সারাদেশে হিট অ্যালার্ট জারি ইসরায়েলের সঙ্গে গুগলের চুক্তি, প্রতিবাদ করায় চাকরি গেলো ২৮ কর্মীর তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে ৯৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ: আবেদন যেভাবে নওগাঁয় দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রী নিহত ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ একীভূত হচ্ছে ৩০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়টার্সের প্রতিবেদন ; ৫ মিলিয়ন ডলারে মুক্তি পেয়েছে এমভি আব্দুল্লাহ ইসরায়েলে হামলা করেছে ইরান ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম ইরানের শক্তিশালী ৯ ক্ষেপণাস্ত্র নওগাঁয় ৪২ কেজি ৫০০ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেফতার ২ মান্দায় মদপানে তিন কলেজ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা নওগাঁর মান্দায় বিষাক্ত মদপানে তিন বন্ধুর মৃত্যু সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন: প্রধানমন্ত্রী ঈদের ৫ দিনের সরকারি ছুটি শুরু

সেলিনা হোসেন এর গল্প ‘চে’র প্রেম ও চুমু’

প্রজন্মের আলো / ১৬০ শেয়ার
Update রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১
ছবি সংগৃহীত

তোমরা যে যেখানে আছ মাটিতে বা জলে শহরে বা গ্রামে  দূরে বা কাছে, তোমরা মনে করো আমি হেঁটে যাচ্ছি সীমান্তবিহীন একটি মহাদেশের সব দেশ ছুঁয়ে। আমি জানি তোমরা এমন চিন্তা করতেই পারবে না। সব দেশেরই সীমানা আছে। সময় এখন তেমন নেই। তোমাদের পক্ষে এমন ধারনা করাও মুশকিল। কিন্তু তোমাদের বলি শোন, আমি একসময় এমনই ভেবেছিলাম। যখন আমি মোটর সাইকেলে করে একটি মহাদেশের সবকটি দেশ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম।
আমার স্বপ্নে ছিল প্রেম।
মানুষের জীবনবদলের দায়ে প্রেম। মনে করো তার নাম বিপ্লব। বিপ্লব আমার প্রাণের মানুষ। যদি আমি পুরুষ হই তবে বিপ্লব নারী। যদি আমি নারী হই তবে বিপ্লব পুরুষ। ভেবোনা এটি কোনো বানোয়াট গল্প। এটি জীবনের গল্প।
ভেবে দেখো এই স্বপ্নের গামছাটা মাথায় বেঁধে আমি পার হয়ে যাচ্ছি আর্জেন্টিনা। জিজ্ঞেস করলে, এমন একটি সুন্দর গামছা কোথায় পেলাম? এই গামছা বাংলাদেশের পাবনা জেলার তাঁতীরা আমাকে উপহার পাঠিয়েছে। ওরা নিজেদের তাঁতে এই গামছা বোনে।
এই গামছাকে নিজের আঁকা ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় বেঁধে দিয়েছেন বাংলাদেশের একজন অসামান্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। সেই যোদ্ধাদের হাতে রাইফেল উঠেছিল একাত্তর সালে দেশের স্বাধীনতার জন্য।
কি বললে? তোমরা একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম শুনতে চাও? কেমন কথা হলো? একজনের নাম আমি কি করে বলবো? ওরাতো হাজার হাজার? একটি নামকে তোমরা হাজার নাম মনে করবে? তাহলে শোন একটি নাম। তার নাম রুমী। আমেরিকায় পড়তে না গিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিল ও। ওর মা জাহানারা ইমাম বলেছিল, তোকে আমি দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম।
চমকে উঠলে কেন তোমরা? এমনই সাহসী ছিল একাত্তর সালের বাংলাদেশের মানুষ। তোমাদের চোখে পানি কেন? কাঁদবে না। তোমরা ওদের সাহসকে স্যালুট করো।
তুমি কোথায় যাচ্ছ চে গুয়েভারা?
আমি লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ঘুরবো। মহাদেশের দারিদ্র্য আর বঞ্চনা দেখবো। আমার বন্ধু আলবার্তো আছে আমার সঙ্গে।
আমরা যাবো তোমার সঙ্গে।
সমবেত কন্ঠের ধ্বনিতে চে’র মাথা ঝিমঝিম করে।
কথা বলছো না যে চে?
অবশ্যই তোমরা আমার সঙ্গে থাকবে। তোমরা তো আমার বিপ্লবের বন্ধু। এখন তোমরা নিজ নিজ জায়গায় থাকো। প্রয়োজন হলে আমার ডাক পাবে।
থ্যাঙ্কু চে।
আবার সমবেত কন্ঠ ধ্বনিত হয়।
আমি কোথায় তা তোমাদেরকে জানানোর জন্য বলছি, আমি এখন চিলিতে। মোটর সাইকেলের ভটভট শব্দ নিয়ে ছুটছি, ছুটছি। পেরিয়ে যাই জনপদ। দেখতে পাই গ্রাম ও মানুষের ছবি। পথের ধারের একটি ছনের ঘরের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়াই। দেখতে পাই আঙ্গিনায় পিঁড়ি পেতে বসে আছেন নেরুদার মা। বয়সের ভারে কাবু হয়ে পড়েছেন। চোখে ঠিকমতো দেখতে পান না। চারদিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কে গো?
বললাম আমার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ও আমার বন্ধু মানিক।
তিনি বললেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
আপনার কাছে এসেছি।
আমার কাছে কেন?
আপনিতো সেই ইন্দির ঠাকুরণ। সামান্য একটু ছাতু খেয়ে দিন কাটান।
ঠিক বলেছো যে ছাতু খেয়ে দিন কাটাই। তবে আমার নামটি ঠিক বলোনি।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছি। আপনাদের সবার একটাই নাম।
সব মানুষের একটা নাম হয় নাকি?
হয়, হয়। আমি চিৎকার করে বলি। এত জোরে চিৎকার করি যে ছেলেমেয়েরা ভয় পেয়ে যায়। একজন কেঁদে ফেলে। আশপাশে ঘুরতে থাকা হাঁস-মুরগি দৌড়ে পালায়। শূকরটিও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
বয়সী নারী আমার দিকে তীক্ষè চোখে তাকাতে চান। কিন্তু তাঁর ঘোলাটে চোখের তেমন শক্তি নেই। রুক্ষ কন্ঠে বলেন, সবার নামটা কি বলবে?
আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি দারিদ্র্য।
ও তাই। তিনি ভুরু কুঁচকে বলেন, এটা সব মানুষের নাম না। তোমাকে যারা নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় এটা তাদের নাম হবে না। ওদের নাম আলাদা। আমিতো বুঝে গেছি যে ওদের সঙ্গে তোমার লড়াই। ওদের আলাদা একটি নাম আমি তোমাকে দেবো।
কি নাম দেবেন বলুনতো? শকুন না শূকর?
খামোখা পশুপাখিগুলোকে গাল দিচ্ছ। ওদের কোনো অপরাধ নেই। তুমি অপরাধীদের জন্য একটি নতুন নাম খুঁজে বের করো। নাম খুঁজে না পেলে আমার কাছে এসো।
এখন যাই গ্র্যান্ড মা।
তোমাদের যে কিছু খাওয়াবো তেমন কিছু আমার ঘরে নাই।
আমরা এসব জানি। আমরা খেতে চাই না। আমরা অনেক দিন ও রাত পানি খেয়ে কাটিয়ে দেই।
হা-হা করে হাসেন নেরুদার বৃদ্ধ মা। বলেন, ঈশ্বর আমাদের জন্য পানি ও বাতাস দিয়েছেন ইচ্ছেমতো খাওয়ার জন্য।
তিনি হাসতেই থাকেন। হাসতে হাসতে দেখতে পান আমাদের মোটর সাইকেল ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে তাঁর হাসির শব্দ। বুঝতে পারি ওই হাসি বিপ্লবের ধমনী ওর ভেতরে বয়ে যাচ্ছে মানুষের আনন্দ। বিপ্লব সফল হলে মানুষেরা শস্য ও মৎস্য পানি ও বাতাসের মতো ইচ্ছেমতো খেতে পারবে।
আমরাও হাসতে হাসতে মনে করো চলে যাচ্ছি ভেনেজুয়েলা। আমাদের ঠিকই দেখা হবে হুগো শ্যাভেজের মায়ের সঙ্গে।
তুমি অনেক স্বপ্ন দেখতে পারো বন্ধু।
শ্যাভেজের গ্রামটি আমাকে খুব টানে। ওই গ্রামের মানুষের ভীষণ অভাব আছে। পাশাপাশি উৎসব আছে। মানুষ দারিদ্র্যকে পায়ে ঠেলে হুলে­াড়ে মাতে মদের হুলে­াড়, নাচ-গানের হুলে­াড়  শেষ পর্যন্ত সম্ভোগের হুলে­াড়ও।
আলবার্তো বুঝতে পারে না যে চে কোন শ্যাভেজের কথা বলছে। চে’র ঘাড়ে মুখ রেখে বলে, তুমি কোন শ্যাভেজের কথা বলছো?
ও এখনো জন্মগ্রহণ করেনি।
বোকার মতো কথা বলো না চে।
আমরা ওকে দেখতে পাবো না। কিন্তু ও একদিন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হবে।
বোগাস! থামো।
কেন?
আমি এখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকবো।
আমি মোটর সাইকেল থামাই। আলবার্তো জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলে ভেনেজুয়েলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। আমি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি না। আমি ঘাসের ওপর চিৎপাত শুয়ে থেকে গভীর নীল আকাশ দেখি।
তোমরা দেখো আমি এখন মেক্সিকোতে। এখান থেকে আমি আর ফিদেল ক্যাস্ত্রো একটি পুরনো জাহাজ নিয়ে রওনা করবো কিউবার দিকে। তোমরা দেখবে আমাদের হাতেই কিউবার বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটবে। আমরা বিজয়ী হবো।
হা-হা করে হাসতে থাকে সহযোদ্ধারা। তোমরা দেখো ওরা বিজয়ের আকাক্সক্ষায় উৎফুল­। ওরা বুঝতে পারছে যে ওরা স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে হটিয়ে দিতে পারবে। ওরা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। ওরা প্রবলভাবে আত্মবিশ্বাসী।
তুমিও কি উৎফুল­ চে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা যুদ্ধ করবো। যোদ্ধাদের হারাবো। এবং আমরা বিজয়ী হবো। তারপর ফিদেল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। আমি ওদের জন্য অনেক কাজ করে দেবো। দেশটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের আদর্শ দেশ হবে।
তোমরা জানো না সেদিন আলবার্তো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। ওর দৃষ্টিতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছায়া ছিল। আর আমি জানতাম আমার এই যোদ্ধা বন্ধুকে আমি বিপ্লবের জন্য বলী হতে দেখবো। আমার কান্নার সময় থাকবে না। আমি অন্য যোদ্ধাদের কান্নার সুযোগ দেবো না। আমি চাই প্রতিটি মানুষ মানুষের প্রতি অন্যায় সংঘটিত হলে নিজের বুকের ভেতরে তা বোঝার সুযোগ তৈরি রাখবে। যে তৈরি করতে পারবে না সে বিপ্লবের স্বরূপ বুঝবে না।
ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে হবে। সেটাই বিপ্লবের আদর্শ, সত্যের সৌন্দর্য এবং মহত্বের বিকাশ।
তোমরা মনে করো আমরা এখন হাভানার পথে আছি। কিউবার রাজধানী হাভানা এখন বাতিস্তা সরকারের শেষ ঘাঁটি। প্রায় দু’মাস ধরে যুদ্ধ করে আমরা ওদেরকে কাবু করে ফেলেছি। ওদের আর পিছু হটার উপায় নেই। ফিদেল আমাকে বলে, দেখো বন্ধু আমরা ওদের দশ গুণের বেশি সৈনিকের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। ওদের অস্ত্রশস্ত্রও কয়েক গুণ বেশি।
আমি হাসতে হাসতে বলি, তারপরও ওরা আমাদের সঙ্গে টিকতে পারছে না, এই তো তুমি বলতে চাও ফিদেল।
ফিদেল হেসে বলে, শুধু বলতে চাইনা, এর উত্তরটাও আমার জানা আছে চে।
বলো দেখি উত্তরটা কি?
তোমার অসাধারণ রণকৌশল বন্ধু।
আমি ফিদেলকে জড়িয়ে ধরে বলি, সব সাফল্য আমাদের সবার।
ভেবে দেখো তোমরা যে আমাদের না খেয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের যোদ্ধারা সেজন্য অভিযোগ করেনি। কারও মুখে কথা ছিল না। ওদের মধ্যে অবিচার-শোষণ বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওরা প্রকৃত বিপ্লবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিল। বেশ কয়েকদিন আমাদের কোনো খাবার ছিল না। তোমরা বোঝ, বিপ্লবীরা কত সাহসী হলে খাদ্যদ্রব্যের মতো বেঁচে থাকার উপকরণকে উপেক্ষা করতে পারে! আমরা বিপ্লবের এই বাণী প্রতিটি মহাদেশের সর্বত্র নিয়ে যেতে চাই। আমরা একদিন সফল হবোই।
কিউবা ফিদেলের দেশ। আমরা হাভানা শহর দখল করেছি। পতন ঘটেছে বাতিস্তা সরকারের। বিজয়ের রণতূর্য ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। আমরা কেউ ক্লান্ত নই। কে যেন প্রশ্ন করে, তোমরা কতটা পথ পার হয়ে এসেছো?
আমি বলি, হাজার হাজার মাইল।
তোমরা কতটা ক্লান্ত?
ওই শব্দটা আমরা শুনিইনি।
তোমাদের ঘুম পায়নি?
না, আমাদের ঘুম পায়নি। আমরা ঘুমুতে চাই না। আমাদের সামনে অনেক কাজ।
দৌড়ে আসে ছেলেমেয়েরা। বলে, আমরা লেখাপড়া শিখতে চাই। আমাদের স্কুল বানিয়ে দাও।
তোমরা আর কি চাও
একটি পাউরুটির কারখানা।
বুঝেছি পাউরুটি খেয়ে স্কুলে যাবে আর লেখাপড়া শিখবে। তাই না?
হ্যাঁ, তাই। তোমাকে বিপ্লবের লাল সালাম, চে।
বোঝ ব্যাপারটা, ওইটুকু ছেলেমেয়েরা কতদ্রুত নিজেদের জায়গাটা বুঝে নিয়েছে।
এরপর কত বছর পেরিয়ে গেলো আমি মনে রাখতে পারিনা। একদিন সমুদ্র সৈকতে কিশোর বালকটি আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি মন খারাপ চে?
হ্যাঁ, একটু তো মন খারাপ।
কেন?
কারণ আমার কিউবা থেকে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে।
ও তাই। তুমি আমাদের দেশে অনেকদিন কাটালে। কবে যাবে?
যে কোনো একদিন।
বুঝেছি, বলবে না। গুড বাই চে।
আমি অবাক হয়ে দেখি সেই কিশোর সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ও যে ঢেউয়ের মাতামাতিতে কোথায় হারালো আমি আর খুঁজে পাইনি। কিউবার রাজনৈতিক দূত হয়ে আমি যখন ছুটে বেড়াচ্ছি এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তখন ভেবেছিলাম কোথাও না কোথাও ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে। কিন্তু হয়নি। আমিতো জানি ও সব দেশে আছে। কোথাও না কোথাও ওকে থাকতেই হবে।
আমি যেদিন জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে নতুন দেশ কিউবার কথা বলছিলাম তখন ও আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল। ও একবার আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলেছিল, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকবে বিপ্লবী কিউবা। তুমি এ সত্যের ঘোষণা দাও চে।
আমি যখন এ কথা বলে বেরিয়ে আসি তখন ও আর আমার সঙ্গে ছিল না। ভেবে দেখো তোমরা, ও এখন কত বড় হয়েছে। একদিন কঙ্গোতে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ও তখন পরিপূর্ণ যুবক। জিজ্ঞেস করলাম, কি করছো এখন?
বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছি।
আমিও

ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আমি জানি তুমি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়তে। তারপর একদিন মেডিকেল কিট ফেলে দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিলে। অস্ত্রটা ফেললে না। এখনো অস্ত্রটা পাশে রেখে কঙ্গোর জঙ্গলে রাত কাটাচ্ছো।
আমি ওর কথায় হা-হা করে হাসি। আমার হাসি থামলে ও আমাকে বলল, তোমার বান্ধবীর নাম আমি জানি।
আমি চুপ করেই থাকি। ও আমাকে আবার বলে, তোমার বান্ধবীর নাম জ্যাকি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসতো।
আমি আবার জোরে জোরে করে হাসি। আমার মাথার ওপরের গাছ থেকে উড়ে যায় একদল পাখি। কঙ্গোর জঙ্গলের ওইসব পাখির নাম আমি জানি না। জানতেও চাই না। আমার বুকভরে উড়তে থাকে জ্যাকির নাম। আমি একদিন জ্যাকিকে গভীর উষ্ণতায় বুকভরা আবেগে চুমু খেয়েছিলাম। জ্যাকির সঙ্গে অনেক বছর আমার আর দেখা নাই। আমি জানি না ও এখন কোথায় আছে। আমি আর ওর খোঁজ রাখতে পারিনি। আমি শূন্যে হাত ওঠাই। ভাবি, যদি জ্যাকির হাতটা ছুঁতে পারতাম। যদি ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারতাম, আমি আমার চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিতে চাই মানুষের ভালোবাসার সবটুকু জায়গা! আহ্ জ্যাকি! এই গভীর জঙ্গলের বসন্তের নতুন পাতাভরা গাছের মাথায় জীবনের নতুন ছবি দেখতে চাই। কিন্তু পারবো না। কঙ্গোতে বিপ্লব সফল করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। আমিতো ওদের সমাজতন্ত্রী সাম্বা আন্দোলনকে সমর্থন দিতে এসেছিলাম। কিন্তু এদের অনেক ত্র“টি আছে। এদের নেতারা যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। অদক্ষ। দুর্নীতিবাজ। আমি তেরো জন যোদ্ধাকে কিউবা থেকে এনেছিলাম। ছয়জন আমার চোখের সামনে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমি ঠিক করেছি আমার সাতজন সঙ্গীকে নিয়ে কঙ্গো ছেড়ে চলে যাবো। আপাতত কিছুদিন গোপন জায়গায় অবস্থান নেবো। তারপর বলিভিয়া যাবো।
সেই তরুণ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
কেমন আছ চে?
শরীরটা ভালো নেই দেখছো।
তা নয়, তুমি আগের চেয়ে অনেক সুস্থ হয়ে উঠেছ।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো। তবে আরও দু-এক মাস লাগবে আরো সুস্থ হতে।
হা-হা করে হাসে তরুণ। বলে, তোমার আবার সুস্থতা! আমিতো জানি তুমি সুস্থ হতে না হতেই উরুগুয়ের এক ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বলিভিয়ায় ঢুকবে। তুমি বেশ পারো। তখন একটি ছদ্মনাম নেবে। যেমন তুমি একটি ছদ্মনামে কঙ্গোতে ঢুকেছিলে। এমন ছদ্মনাম নিয়ে নিজেকে তোমার অন্য রকম মানুষ মনে হয় না চে?
একদমই না। আমিতো মানুষ একটাই। আমার নাম বিপ্লব।
গুডবাই চে।
ছেলেটি চলে গেলে আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। কেউ একজন এসে বলে, এই জুসটা খাও।
আমি একগ্লাস জুস খাই।
ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, রাতে ব্রেড খাবে নাকি নুডল?
আমি বলি, ব্রেড। ও চলে যায়। শুকনো ব্রেডই আমাদের জন্য সহজ খাবার। ঝামেলা করে নুডল রান্নার প্রয়োজনই মনে করি না আমি। আমরা সবাই। তারপরও আমরা ভালো আছি।
জ্যাকি আমি এখন বলিভিয়ায় ঢুকেছি। তুমি হয়তো কোথাও কোনো কাজে ব্যস্ত আছ, কিংবা কোনো অপারেশন থিয়েটারে সার্জারিতে মন দিয়েছ। আমাকে কি তোমার মনে পড়ে জ্যাকি? আমরা দু’জনে অনেক মধুর সময় কটিয়েছিলাম। বলিভিয়ার পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমি তোমাকেই দেখতে পাচ্ছি যেন। আমার মুগ্ধতা কাটতেই চায় না।
আমার সঙ্গে পঞ্চাশ জন সঙ্গী আছে জ্যাকি। আমি বলিভিয়ার বিপ্লব সফল করে ছাড়ব। এখানকার পাহাড়ি অঞ্চল গেরিলা যুদ্ধের জন্য খুবই উপযুক্ত। যখন রণকৌশল ঠিক করি তখন আমার মাথায় অবিচারের স্বরূপটি প্রবল হয়ে ওঠে। আমিতো জানি সব ধরণের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার। কারও উচিত নয় কাউকে এই প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা। তোমরা ভেবে দেখো, একজনের ভোগবিলাসের জন্য অন্যজনের হাহাকার ধ্বনিত হবে কেন। ভেবে দেখো বিচার না পাওয়া মানুষের জন্য কত অবমাননার! আমাদের সামনে থেকে এমন সময়কে সরিয়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে পঞ্চাশ জন সঙ্গী আছে। আমি বলিভিয়ার বিপ্লব সফল করবই। আমার বিশ্বাস এখানকার কম্যুনিস্ট পার্টি আর জনগণ আমাকে সহযোগিতা দেবে। যদি সিআইএ-র ষড়যন্ত্র গভীর হয় তবে আমাকে রণকৌশল বদলাতে হবে। সিআইএ এবং তার মদদপুষ্ট সেনাবাহিনী এখন আমার বড় শত্র“।
আমার দিনগুলো এখন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে এখন আমি অনেক বিপদের মধ্যে আছি। শর্ট ওয়েভ রেডিও নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে আমি হাভানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছি না। ফিদেলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। অপরদিকে কম্যুনিস্ট পার্টি এবং জনসাধারণের সহযোগিতা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। তোমরাতো জানো গেরিলা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা কত জরুরি!
তোমরা সবাই শোন, আমি এখন বলিভিয়ার সিআইএ সমর্থিত সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী। ওরা আমাকে গুলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ভয় পাই না। সাম্যবাদী আদর্শে মানুষের জীবন থেকে শোষণ-বঞ্চনা দূর করার যে যুদ্ধে আমি নেমেছি তার সাফল্যের কাছে মৃত্যুতো তুচ্ছ ঘটনা।
একজন ব্যক্তিকে ওরা গুলি করবে মাত্র। মানুষের মৃত্যুতো হবেই কোনো না কোনো ভাবে। কিন্তু আমি না থাকলে কোথাও কিছু এসে যাবে না, থাকবে বিপ্লবের বাণী। বিপ্লবের সঙ্গে আমার প্রেমই চিরস্থায়ী।
নারী কন্ঠ ভেসে আসছে, চে।
আমি চারদিকে তাকাই।
চে, আমাকে দেখো।
আমি দেখতে পাই রাইফেলের নল। ট্রিগার টিপলে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে আমার বুক। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলি, রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন তোরা? মার, শালারা, মার।
বাতাসে নারীর ভালোবাসার কন্ঠ ধ্বনিত হয়, চে একদিন তুমি আমাকে চুমু খেয়েছিলে, মনে আছে?
ওহ জ্যাকি! এখন তোমাকে আমার খুব মনে পড়ছে। তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?
আমাকে আরও কেউ কেউ চুমু খেয়েছে চে। আমিও স্বেচ্ছায় চুমু খেয়েছি কাউকে। কিন্তু কারও কথা আমি মনে রাখিনি। তোমার চুমুই আমার জীবনে বেঁচে আছে। আমৃত্যু বেঁচে থাকবে, চে। সেদিন চুমু খাওয়ার পরে তুমি বলেছিলে, তুমি আমার ধরিত্রী। আমি বিপ্লবের বাণী নিয়ে ধরিত্রীর কোলে মাথা রাখব। বিপ্লবই পারে ধরিত্রীকে সুন্দর করতে। তোমার মনে আছে চে?
আছে, মনে আছে জ্যাকি।
তাহলে হাত বাড়াও। তোমাকে ছুঁয়ে দেখি আর একবার।
নাও, আমার হাত ধরো। তোমার গভীরে ভরে নাও ভালোবাসার গন্ধ।
সেমিঅটোমেটিক রাইফেল থেকে ছুটে আসে বুলেট।
মাত্র নয়টি বুলেট বিদ্ধ হয় বিশালদেহী বিপ্লবীর শরীরে।
দৈনিক পূর্বকোণ, ফেব্রয়ারী- ২০১১


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও সংবাদ

Categories