অপরূপ সৌন্দর্যের মায়ায় ঘেরা এই বাংলার রূপ। কখনো সবুজের হাতছানি আবার কখনো অচেনা কোনো পাখির সুর। কখনো শান্ত দীঘির জল, কখনো মাথার ওপর বিশাল আকাশ। এই রূপের মোহে বন্দি হয় যে কেউ। এমনই এক প্রাকৃতিক স্থান নওগাঁর
শালবন আলতাদীঘি উদ্যান।
শালবনের নিবিড় ভালোবাসা জড়িয়ে আপনি যখন এগিয়ে যাবেন তখন পায়ে বেদনার মর্মর সুর তুলবে শুকনো পাতার দল। নির্জন বনে চেনা অচেনা পাখির সুরে হয়ত উদাসী হয়ে উঠবে আপনার মন। আপনার পায়ে হাঁটা পথের পুরোটা জুড়ে সঙ্গী হয়ে থাকবে শান্ত এক দিঘীর জল, নাম যার আলতাদীঘি। পথ হাঁটতে হাঁটতে একসময় থেমে যেতে হবে কাঁটা তারের বেড়ার প্রান্তে। সূচালো কাঁটার তার জানান দেবে, ওপারে ভিন্ন দেশ। তারপর আবার এই দিঘীর কাছ ঘেঁষে হেঁটে চলা।
ধামইরহাটের শালবন হতে পারে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমি নগোঁর ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন শালবন। নওগাঁ জেলা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা ধামইরহাট উপজেলার ২৬৪.১২ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে এই শালবন।
ধামইরহাট থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার পথ পেরুলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সাজানো নয়নাভিরাম সেই প্রাচীন শালবনটি। ৬ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে লাল মাটির রাঙা পথ। দূর থেকেই নজরে পড়বে সেই প্রাচীন শালবনটি।
শালবনে শুধু শালগাছ নেই পাশাপাশি অন্য গাছেরও দেখা মিলবে। মন জয় করা এই শালবনে প্রাণ জুড়াতে আসে অনেক ভ্রমন পিপাসু পর্যটক।
শালবনের পথ যেখানে শেষ সেখানেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। কাছাকাছি সীমান্তের পিলার। বেড়ার ওপাড়ে দেখা যায় ভারতীয়দের কৃষিকর্ম আর বিএসএফের টহল। এই বনের অন্যতম আকর্ষণ শালগাছকে জড়িয়ে উঠে গেছে হিংলো লতা, অনন্তমূল ও বনবড়ইসহ নানা লতাগুল্ম আর বনফুল। বনের ভেতরে ঢুকতেই নাকে ভেসে আসে নাম না জানা নানা রকমের বনফুলের মিষ্টি গন্ধ। আর মাঝে মাঝে আছে ঘন বেত বন। বেত গাছের সবুজ চকচকে চিকন পাতায় চোখ জুড়িয়ে আসে। এই বনে আছে সাপ, শিয়াল, খরগোস, বনবিড়াল ও বেজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি আর পাখি। পাখির কলতানে মুখরিত সমগ্র শালবন।
বনের দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই অনুভূতি হবে রোমাঞ্চকর। পথের ধারে ছোট ছোট বসতবাড়িগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। বরেন্দ্র ভূমির চারিদিকে শুধু উঁচু-উঁচু শালগাছ। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই শালবন যেন প্রকৃতির গোপন রহস্যে ঘেরা। এই বনভূমি সরকারের রির্জাভ ল্যান্ড ফরেস্ট হিসেবে সংরক্ষিত। প্রাকৃতিক এই বনভূমির মাঝে নেই কোনও কৃত্রিমতা।
এক সময় শালবনটির মালিক ছিলেন কলকাতার পাথর ঘাটার জমিদার অত্যানন্দ ঠাকুর। তিনি দৈবক্রমে অন্ধ হয়ে যান। ফলে তার স্ত্রী অক্ষয় কুমারী দেবী জমিদারি পরিচালনা করতেন। উপজেলার আড়ানগরে তাদের কাছারি বাড়ি ছিল (বর্তমানে বাড়িটি তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে)। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে প্রতি বছর ৩০ চৈত্র পরিপক্ক শালগাছগুলো নিলামে বিক্রি করতেন। জমিদারের কর্মচারীরা আগেই পরিপক্ক গাছগুলো চিহ্নিত করে রাখতেন। দূর-দূরান্ত থেকে কাঠ ব্যাসায়ীরা প্রকাশ্যে ওই নিলামে অংশ নিতেন। অক্ষয় কুমারীরর উপস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে শেষবারের মতো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে আর সেখানে ওই জমিদারের কেউ আসেননি।
শালবনের মাঝে জায়গা করে নিয়ে বড় বড় ঢিবি গড়ে তুলেছে উই পোকা। যা নিজের চোখে দেখলেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না এটা উই পোকার ঢিবি। লালচে রঙ্গের এই ঢিবিগুলো প্রবল বর্ষণেও নষ্ট হয় না। উই পোকারা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় সারা বছর। শালবনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার জন্য ২৪ জন নিয়োজিত রয়েছে।
বর্তমানে এটি পর্যটন কেন্দ্র না হলেও প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসে। প্রকৃতির বনভূমি শালবনে কোনও বিশ্রমাগার না থাকলেও বনের উত্তর ধারে অনেকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যারা বেড়াতে আসেন তারা এই ফাঁকা জায়গায় বসে নির্মল বাতাসে আরাম করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে ১৭০ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ওষুধি গাছ ও বেত বাগান করা হয়েছে। তাছাড়া জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য এখানে অজগর সাপ ২টি, মেছোবাঘ ৮টি, বনমোরগ ১৪টি, গন্ধগকুল ২টি অবমুক্ত করা হয়েছে। এই উপজেলা প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রতিদিন এই শালবন দেখার জন্য শত শত লোকজন আসে। আশা করছি অতি দ্রুত এই জাতীয় উদ্যানের কাজ শুরু হবে। এটি হলে এলাকার চেহারাই পাল্টে যাবে।
নামকরণ থেকে শুরু করে জন্ম ইতিহাস— সবকিছুতেই জড়িয়ে রয়েছে কল্পকথা। কথিত আছে অক্ষয় কুমার চৌধুরানী (জন্ম- মৃত্যু অজানা) আদেশ করেন, তিনি যতদূর হেঁটে যাবেন ততদূর পর্যন্ত দীঘি খনন করতে হবে। এভাবে তিনি এককিলো হাঁটার পর কর্মচারীরা তার পায়ে আলতা ছুঁয়ে দেন আর বলেন, ‘রানী মা, আপনার পায়ে রক্ত’। এ কথা দাঁড়িয়ে যান রানী। আর একারণেই এই দিঘীর নামকরণ করা হয় ‘আলতাদিঘী’।
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় বনভূমি শাল বনের মাঝখানে আলতাদিঘির অবস্থান। ভারতের বর্ডার এর পাশ ঘেঁষে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের প্রায় সীমান্ত ঘেষা, নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা থেকে ৬ কিঃমিঃ দূরে একটি ঐতিহাসিক দিঘীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সুবিশাল বনভূমি।
কথিত আছে, আনুমানিক ১৪০০ সালে এ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা বিশ্বনাথ জগদল। রাজার রাজত্বকালেই একবার পানির প্রকট অভাব দেখা দেয়। মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির হওয়ায় আবাদি জমিতে ফসল ফলানো হয়ে ওঠে অসম্ভব। হঠাৎ একদিন রাণী স্বপ্নে দেখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পা ফেটে রক্ত বের হবে ততক্ষণ তিনি হাঁটতে থাকবেন এবং যেখানে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বের হবে ততদূর পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিতে হবে।
প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দূর করে রানী স্বপ্ন অনুযায়ী হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন। সঙ্গে ছিল রানীর পাইক পেয়াদা, লোক লস্কর। অনেক দূর হাঁটার পরও যখন রানী থামছিলেন না, তখন পাইক-পেয়াদারা ভাবলেন এত বড় দিঘী খনন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হবে না। এসময় তাদের একজন রানীর পায়ে আলতা ঢেলে দিলেন আর চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘রানী মা, আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। একথা শুনে রানী সেখানেই বসে পড়েন।
রাজা বিশ্বনাথ ওই স্থান পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিলেন। এরপর অলৌকিকভাবে মুহূর্তেই বিশুদ্ধ পানিতে ভরে ওঠে দিঘী। রাণীর পায়ে আলতা ঢেলে দেয়ার প্রেক্ষিতে দিঘীটির নামকরণ করা হয় আলতাদিঘি।
আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে মেছোবাঘ, অজগর বানরসহ নানা বন্য প্রানী। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, পোকামাকড় রয়েছে এখানে। যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো শালগাছকে আলিঙ্গন করে গড়ে ওঠা উঁই পোকার ঢিবি।
২৬৪ এককের বিশাল বনভূমির ঠিক মাঝখানেই রয়েছে প্রায় ৪৩ একর আয়তনের আলতাদিঘি। এটি ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং শূন্য দশমিক ২ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট। যদিও গুরুত্ব অনুযায়ী এই বনভূমি বা দিঘীর যত্ন নেওয়া হয় নামমাত্র।
দেশের সব জায়গা থেকেই জেলা সদর নওগাঁয় আসা যায়। এরপর নওগাঁ বালুডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকে সাপাহারের বাসে উঠে দিবর দিঘির মোড়ে নামতে হবে। নওগাঁ জেলা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা ধামইরহাট উপজেলার ২৬৪.১২ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে এই শালবন।
নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৬০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যেতে হবে জেলার ধামইরহাট উপজেলা সদরে। পথে পড়বে মহাদেবপুর, পত্নীতলা উপজেলার সদর। ধামইরহাট থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার পথ পেরুলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সাজানো নয়নাভিরাম সেই প্রাচীন শালবনটি। ৬ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে লাল মাটির রাঙা পথ। দূর থেকেই নজরে পড়বে সেই প্রাচীন শালবনটি।
নওগাঁ সদরে আপনি ভালো আবাসিক হোটেল পাবেন। এখানে থাকার জন্য ১৫০ থেকে ১৫০০ টাকা মধ্যে রুম পাবেন। এসি রুমও আছে সেক্ষেত্রে বাজেট বাড়াতে হবে। আর খাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলো পাবেন হাতের কাছেই।